ভুল – বিনিয়ামীন পিয়াস
অস্থির লাগছে রাফির।
আসলে মাঝে মাঝে এমন দিন আসে, যেদিন কিছুই ঠিকমত হয় না! আজ তেমনই একটা দিন। সামনের দেয়ালে লাগানো ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকালো সে। গত একঘণ্টায় মনে হয় দশবার সে ঘড়িটার দিকে তাকিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে সময় এগুচ্ছেই না!
চেয়ারে হেলান দিয়ে রাফি তার চোখদুটি বন্ধ করে কাল রাত থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবকিছু মনে করার চেষ্টা করছে। আসলেই কি তার কোনো দোষ আছে, নাকি সবটাই…? অদ্রি, রায়হান, ইরিনা … এদের ব্যাপারগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। নাহ, এ নিয়ে ভাবাভাবির আর কিছুই নেই। সে মনে মনে দুটো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজই এসবের একটা সমাধান করে ফেলবে। বেটার লেট দ্যান নেভার!
ঘড়ির লম্বা কাঁটাটা বারোর উপরে আসতেই বেতোভেনের চমৎকার একটা সুর বেজে উঠল। রাফি ড্রয়ার থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হ্যান্ডব্যাগটাতে ভরে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
রাতের অন্ধকার কেটে কালো রঙের নিসান জিউক গাড়িটা বেশ দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে উত্তরার দিকে। রাতের এ সময়টাতে রাস্তা একদম ফাঁকা থাকে। নির্জন রাস্তার বুক চিরে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়ি, তারচেয়েও দূর্বার গতিতে চলছে রাফির মস্তিষ্ক। রায়হানের সাথে তার পরিচয় সেই স্কুল জীবনে। সপ্তম শ্রেণীতে যখন ঢাকায় এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয় তখন স্বভাবতই অনেকেই তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিলো। তবে তার উগ্র মেজাজের কারণে বন্ধুত্ব হয়নি তেমন কারো সাথেই, শুধুমাত্র রায়হানই ছিলো ব্যতিক্রম। ঠান্ডা মেজাজের ছেলেটি খুব সহজেই উগ্র মেজাজের রাফির বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো। এরপর একসাথে কলেজ, ভার্সিটি লাইফ পার করেছে দুজনই।
ইরিনার সাথে পরিচয় হয়েছিলো ভার্সিটিতে থাকাকালীন। টিপিক্যাল “লাভ এট ফার্স্ট সাইট” টাইপ ঘটনা। টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় দুই বন্ধু আড্ডা দেয়ার সময় পাশের টেবিলে বসে থাকা ইরিনার দিকে চোখ পড়ে রাফির, সে চোখ আর কখনো সরানো সম্ভব হয়নি। ৫ বছরের রিলেশন, শেষমেশ বিয়ে, অনেকটা হ্যাপি এন্ডিংই বলা চলে।
অদ্রির সাথে পরিচয় অবশ্য খুব পুরনো নয়। লাজুক স্বভাবের রায়হান কখনোই প্রেম, ভালোবাসায় তেমন জুত করতে পারেনি, শেষমেশ তাই পরিবারের পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। রায়হান-অদ্রির বিয়ে হয়েছে বছর চারেক আগে, রাফির সাথে ইরিনার বিয়ে হয়েছে প্রায় ৭ বছর হতে চললো।
গাড়ির সামনে হঠাৎ কোত্থেকে এক কুকুর এসে পড়ায় দ্রুত ব্রেক কষে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয় রাফি। কল্পনার জগত থেকে দ্রুত ফিরে আসে বাস্তবতায়। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার পোস্টে চাকরী করছে সে, মোটা অঙ্কের বেতন, ঘরে সুন্দরী বউ, পারফেক্ট লাইফ। সবকিছু চলছিলোও ঠিকঠাক। কিন্তু হঠাৎ কোথায় যেন কি এক ছন্দপতন হলো, যার জন্য আজ তাকে নিতে হচ্ছে কঠিন সিদ্ধান্ত।
***
রায়হান তার বাসার ড্রইংরুমে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। রাফি কি কোন কারণে তাকে সন্দেহ করছে? গতকাল থেকে রাফির ব্যবহার তার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে। প্রত্যেকটা কথাতেই কেমন যেন সন্দেহের সুর ছিলো। রাফির উগ্র মেজাজ সম্পর্কে তার বেশ ভালো ধারণা আছে। ভয়টা সেখানেই! অবশ্য তার প্রতি রাফির সন্দেহ সম্পূর্ণ অমূলক, তবুও মনের কোণে একটা ভয় থেকেই যাচ্ছে। রাফির ভাবনাটা মাথা থেকে সরিয়ে হাসপাতালের ফাইলগুলোর দিকে আরেকবার চোখ বুলালো সে, অদ্রি অন্তঃসত্ত্বা। ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে, এ সময়ে এরকম খবরে সে মোটেও খুশি হতে পারেনি। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো অদ্রিকে, এসময় বাচ্চা নেয়ার কোন ইচ্ছে তার নেই। এনিয়ে একচোট ঝগড়া হয়েছিলো দুজনের মাঝে। রাগের মাথায় বেশিই বাজে ব্যবহার করেছিলো সে, ফলাফল স্বরূও আজ সকালেই ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে অদ্রি।
***
বিয়ের ৩-৪ বছরেও যখন বাচ্চা হচ্ছিলো না তখন ডাক্তার আসগরের শরণাপন্ন হয় রাফি। আসগর তার পুরনো বন্ধু, কলেজে থাকাকালীন একসাথে আড্ডা দিয়েছে বহুসময়। ভার্সিটিতে ওঠার পরও রায়হান, ইরিনা, আসগর আর সে মিলে আড্ডা দিয়েছে বহুবার। ইরিনা আসগরকে কেন যেন খুব একটা পছন্দ করতো না, কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলো রাফি কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি ইরিনা। ইরিনার অপছন্দের কারণেই একসময় দূরত্ব বেড়ে যায় আসগরের সাথে।
তবে সম্প্রতিই আবার ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে যায় আসগরের সাথে। কথাপ্রসঙ্গে বলে ফেলে বিবাহ পরবর্তী জীবন সম্পর্কে। আসগরই পরামর্শ দিয়েছিলো ইরিনাকে নিয়ে তার চেম্বারে যেতে। বন্ধুকে আশ্বস্ত করেছিলো গোপনীয়তার ব্যাপারে।
ইরিনাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিলো আসগরের চেম্বারে যেতে। দুজনেরই চেকাপ করিয়েছিলো সে। ফলাফলে জানতে পারে হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে তার পক্ষে কখনো বাবা হওয়া সম্ভব নয়। টেস্টের আসল রিপোর্টটা লুকিয়ে ফেলে ভুয়া রিপোর্ট বানিয়ে ইরিনাকে জানায় সমস্যাটা তারই। ইরিনার পক্ষে কখনো মা হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তাতে তার কোন সমস্যা নেই। সে সারাজীবন ইরিনাকে নিয়েই বাঁচতে চায়। মিথ্যেটা বলতে তার একটুও বাঁধেনি, ইরিনার মত স্ত্রী হাতছাড়া করার ইচ্ছে তার মোটেও ছিলো না।
অথচ গতকাল রাতে যখন ট্র্যাশব্যাগে প্রেগনেন্সি টেস্টিং কিট খুঁজে পায়, যেটার রেজাল্ট ছিলো পজেটিভ, তখন বিষ্ময়ে মুখ হা হয়ে যায় রাফির। ইরিনাকে তার কখনো সন্দেহ হয়নি, সবসময়ই মনে হয়েছে সে তাকে সত্যিই ভালোবাসে। তাছাড়া তার বাসায় তেমন কারো আসা-যাওয়াও ছিলোনা। শুধুমাত্র তার বন্ধু রায়হানের স্ত্রী মাঝেমধ্যে আসতো ইরিনাকে সঙ্গ দিতে। এমন কি হতে পারে ওই টেস্টিং কিট আসলে অদ্রির? জানার জন্যই ফোন দিয়েছিলো অদ্রিকে।
****
ইরিনা এখনও মাথা থেকে বিষয়টা সরাতে পারছেনা। একবার নয়, দুবার নয়, দশবার টেস্ট করেছে সে, প্রতিবারই রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। রাফির গোপন রিপোর্টগুলো সে খুঁজে পেয়েছিলো বহু আগেই। সে জানতো রাফি কখনোই তাকে সন্তান দিতে পারবে না। কিন্তু তবুও রাফিকে ছেড়ে যায়নি সে, রাফির ভালোবাসা তার অক্ষমতাটুকু পুষিয়ে দিয়েছে। সে নিজেও কখনো ভুল পথে পা বাড়ায়নি। সন্তানের চেয়ে ভালোবাসা তার কাছে সবসময় বড় মনে হয়েছে। কিন্তু এখন সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! তাহলে ওই রিপোর্ট ভুল ছিলো?
***
রাফি অদ্রিকে ফোন দিয়েছিলো গতকালই।
জানতে চেয়েছিলো গত এক সপ্তাহে তাদের বাসায় এসেছিলো কিনা, স্রেফ ভদ্রতার খাতিরেই। উত্তরে অদ্রি না জানানোয়, মনের কোনে সন্দেহটা আরো দানা বেধে ওঠে। কথাপ্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলো রায়হানকে সাথে নিয়ে তাদের বাসায় শেষ কবে এসেছিলো। সম্প্রতি যে আসা হয়নি সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলো অদ্রি। তবে মাস তিনেক আগে একবার অদ্রি তাদের বাসায় তার মোবাইল ফেলে গিয়েছিলো, সেটা আনতে গিয়েছিলো রায়হান।
সময়টা মনে করার চেষ্টা করলো রাফি, অফিসের কাজে তিনদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছিলো তাকে। তিন মাস আগে…!
তাহলে শেষ পর্যন্ত রায়হান!
***
রায়হানের বাসার পার্কিং লটে গাড়ি থামালো রাফি। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় দারোয়ান কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করেই যেতে দিলো তাকে। রাতে এগারোটার পরই এই ফ্ল্যাটের লিফট বন্ধ হয়ে যায়, সিড়ি ভেঙেই উপরে উঠতে লাগলো রাফি। ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটটিতে উঠতে উঠতে নিজের সিদ্ধান্তটা নিয়ে ভাবলো আরেকবার।
***
কলিংবেলের শব্দ শুনে খানিকটা অবাক হল রায়হান, এত রাতে কে আসতে পারে! দরজার ওপাশে রাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হওয়ার মাত্রা আরো বেড়ে যায় তার।
“এত রাতে তুই?” – কন্ঠে বিষ্ময় ঝরে পড়ছে রায়হানের।
“হ্যা, হিসেবটা মিলাতে অনেক রাত হয়ে গেলো। দেরী করার ইচ্ছে ছিলোনা তাই রাতেই চলে আসলাম।” – শীতল কন্ঠে জবাব দিলো রাফি।
***
পুলিশ রায়হানের লাশ উদ্ধার করে রাত দুটোয়।
দারোয়ান ফোন দিয়েছিলো পুলিশকে। রাফি চলে যাওয়ার আগে দারোয়ানকে জানিয়েছিলো খুন করার কথা!
ইরিনার লাশ পাওয়া যায় আরো তিনদিন পর। ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে তীব্র গন্ধ আসায় পুলিশকে ফোন করে জানায় পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে লাশ।
বুড়িগঙ্গার কালো পানির ভেতর ময়লার স্তুপ। এর পানি এতটাই নোংরা আর কালো যে এর ভেতরে কারো লাশ ভাসলেও চোখে পড়বে না। রাফির লাশটা তাই আড়ালেই রয়ে যায় সবার।
***
পুনশ্চঃ
৯ বছর আগে-
রাফি, ইরিনা, রায়হান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর আসগর পড়ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে।
এক রাতে আসগর চলে যায় ইরিনার হলের সামনে, প্রেমের প্রস্তাব দেয় তাকে। কিন্তু ইরিনা জানায় সে রাফিকে ভালোবাসে, সেটা আসগরও জানে। আসগর তখন বিকল্প প্রস্তাব দেয়, ভালোবাসার দরকার নেই তাহলে, তিনদিনের ছোট্ট এক ট্যুরে যেতে বলে তার সাথে, ফাইভ স্টার আবাসিক হোটেলে থাকবে। মাত্র তিনদিনের জন্য, এরপর আর কখনো ইরিনার কাছেও আসবে না সে। বিনিময়ে ইরিনা পাবে মোটা অঙ্কের টাকা। ভীত, ক্রুদ্ধ, হতবাক ইরিনা সেদিন অপমান করে ফিরিয়ে দেয় আসগরকে। উগ্র মেজাজের রাফি জানতে পারলে ঝামেলা করবে এই ভয়ে গোপন রাখে পুরো ঘটনা।
বর্তমান সময়-
আসগরের হাতে রাফির অরিজিনাল রিপোর্ট। ক্রুর হেসে কাগজটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে সে।